ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, বিদায়ী ফার্সি ১৩৯৯ সাল ছিল করোনা মহামারির মোকাবেলায় ইরানি জাতির শক্তি ও সামর্থ্য প্রকাশ এবং সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের মার্কিন নীতির ব্যর্থতার বছর। ফার্সি নওরোজ বা নববর্ষ উপলক্ষে এক বার্তায় তিনি এ কথা বলেন। সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেছেন, এখন শত্রুরা নিজেরাই স্বীকার করছে তাদের সর্বোচ্চ চাপ ব্যর্থ হয়েছে। ফার্সি নববর্ষ ১৪০০ উপলক্ষে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পূর্ণাঙ্গ বার্তা নিচে দেওয়া হলো:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ওয়ালহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন,ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিও ওয়া আলিহিত তহিরিন
ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবসার। ইয়া মুদাব্বিরাল লাইলি ওয়ান্নাহার। ইয়া মুহাওয়িলাল হাওলি ওয়াল আহওয়াল,হাওয়িল হা লানা ইলা আহসানিল হাল। (অর্থ: হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ পরিবর্তনকারী। হে রাত ও দিনের আবর্তনকারী। হে সময় ও অবস্থা পরিবর্তনকারী। আমাদের অবস্থা ভালোর দিকে উন্নীত করুন।)
প্রিয় দেশবাসী বিশেষকরে শহীদ ও যুদ্ধাহতদের সম্মানিত পরিবার, স্বয়ং যুদ্ধাহতবৃন্দ এবং যারাই দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের সবাইকে নওরোজ উৎসব ও নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। একইসঙ্গে বিশ্বের অন্য যেসব জাতি নওরোজ উৎসব পালন করেন তাদের প্রতিও অভিনন্দন। এবারের নওরোজ ও পবিত্র শাবান মাসের উৎসবগুলো একইসঙ্গে এসেছে। ইনশাআল্লাহ এটা নতুন বছরে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে অনেক বরকত এনে দেবে আশাকরি। ফার্সি ১৪০০ সাল দু’টি শবে বরাত পাচ্ছে। নতুন ফার্সি বছরে মানুষ ইমাম মাহদি (আ.)’র দু’টি জন্মদিন পালনের সুযোগ পাবে। (চান্দ্র ও সৌর বর্ষের মধ্যে ১১/১২ দিনের ব্যবধানের কারণে এমনটি হবে।)
বিদায়ী ফার্সি ১৩৯৯ সাল নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে পার হয়েছে, কোনো কোনো ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। যেটা আসলেই জাতির জন্য নজিরবিহীন ও অপরিচিত ছিল তা হলো করোনা মহামারি, এটা প্রায় গোটা জাতির ওপরই কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলেছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়া, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সফর, খেলাধুলা ও অন্যান্য অঙ্গনে করোনা মহামারি প্রভাব ফেলেছে এবং কর্মসংস্থানের ওপর বড় ধরণের আঘাত হেনেছে। সবচেয়ে তিক্ত বিষয় হলো করোনায় দেশের হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। অর্থাৎ দেশের হাজার হাজার পরিবার আজ শোকাচ্ছন্ন। আমি এখানে এসব পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আশাকরি আল্লাহ তাদেরকে ধৈর্য ধরার তওফিক দান করবেন এবং যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদেরকে অনুগ্রহ ও ক্ষমা করবেন।
বিদায়ী ফার্সি ১৩৯৯ সাল একদিক থেকে ইরানি জাতির শক্তি-সামর্থ্য প্রকাশের বছর ছিল। তারা এই মহাপরীক্ষা অর্থাৎ করোনা মহামারি মোকাবেলায় আসলেই বড় ধরণের যোগ্যতা ও সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা খাতের সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি দেশের গবেষক, বিজ্ঞানী,সর্বস্তরের মানুষ এবং জিহাদি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো তাদের শক্তি-সামর্থ্য তুলে ধরেছে। তারা এমন এক পরিস্থিতিতে এটাকে সামাল দিয়েছে যখন শত্রুরা সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করেছে এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে বিদেশি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের নানা পথ বন্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই আমাদের জনগণ এবং বিজ্ঞানী,নার্স,ডাক্তার,প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্ট অর্থাৎ চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত সবাই এক বড় ধরণের যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
একইসঙ্গে ইরানি জাতি শত্রুর সর্বোচ্চ চাপ মোকাবেলায় নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য প্রমাণ করেছে। আমেরিকার নেতৃত্বে শত্রুরা সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ইরানকে নতিস্বীকারে বাধ্য করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু এখন তারা নিজেরা এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা সরাসরি বলছে যে,সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি ব্যর্থ হয়েছে। আমরা জানতাম তারা ব্যর্থ হবে। আমরা শত্রুদেরকে এ ক্ষেত্রে পরাজিত করার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। ইরানি জাতি দৃঢ়তা প্রদর্শন করবে তা আমরা জানতাম। আজ শত্রুরাই স্বীকার করছে যে,সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের নীতি ব্যর্থ হয়েছে।
বিদায়ী ফার্সি ১৩৯৯ সালের শ্লোগান ছিল ‘উৎপাদন বৃদ্ধি’। জনগণ,সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত নানা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যদি আমি মূল্যায়ন করি তাহলে বলতে হবে,এই শ্লোগান মোটামুটি বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্থাৎ দেশের কোনো কোনো সেক্টরে,কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন বেড়েছে। অবশ্য সেটা প্রত্যাশিত পর্যায়ে ছিল না। যেসব সেক্টরে এই শ্লোগান বাস্তবায়িত হয়েছে বিশেষকরে অবকাঠামো ও নির্মাণের মতো খাতেই এর বাস্তবায়নটা বেশি হয়েছে,সেগুলোর প্রভাবও দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি। অর্থাৎ এই কাজগুলোর প্রভাব ভালোভাবে অনুভূত হয়নি। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা ছিল উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে জনগণের অবস্থার ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাস্তবিক অর্থে উৎপাদন বৃদ্ধির শ্লোগানটি পুরোপুরি একটি বিপ্লবী শ্লোগান, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোগান। দেশে যদি সত্যিকার অর্থে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ঘটে তাহলে অর্থনীতিতে এর গভীর প্রভাব পড়বে, মুদ্রার মান বৃদ্ধিসহ অর্থনীতির অন্যান্য মৌলিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে, জাতীয় ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস জোরালো হবে, জনগণের সন্তুষ্টি বাড়বে এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ইনশাআল্লাহ দেশে উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদন যদি বেশি মাত্রায় বাড়ে তাহলে বড় ধরণের কল্যাণ সাধিত হবে।
এখন প্রশ্ন হলো বিদায়ী ফার্সি ১৩৯৯ সালে উৎপাদন বৃদ্ধির শ্লোগান কেন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি? এর কারণ হলো-একদিকে নানা বাধা ছিল,আর অন্যদিকে উৎপাদনের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতায় ঘাটতি ছিল। উৎপাদনের জন্য আইনি ও রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন,তেমনি এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা দূরীকরণও জরুরি। উদাহরণ হিসেবে বলছি,ধরুন আধা-আধি সচল একটা কারখানা,সব মিলিয়ে ৩০ অথবা ৪০ শতাংশ কাজ হয় এমন একটা কারখানা অথবা পুরোপুরি অচল একটা কারখানা চালু করার উদ্যোগ নিলো কয়েকজন উৎসাহী তরুণ, সেটা চালু হলো,কাজ শুরু হলো,কিন্তু উৎপাদন শুরু হওয়ার পর হঠাতই দেখা গেল একই ধরণের পণ্য বিদেশ থেকে ঢোকানো হচ্ছে,সেটা চোরাচালানিদের মতো অপরাধীদের মাধ্যমেই হোক আর আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে বৈধ পন্থাতেই হোক। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন উৎসাহিত হবে না। উৎপাদনের পথে এটা একটা বাধা। অর্থাৎ যে কাজটা চালু হয়েছে তা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
এছাড়া পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রণোদনা না থাকার কারণেও এটা হতে পারে। উৎপাদন সেক্টরে পুঁজি বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনার প্রয়োজন রয়েছে। যাদের পুঁজি বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রয়েছে তাদেরকে এই কাজে উৎসাহিত করতে হবে। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি এমন হতে হবে যাতে তারা এই কাজে উৎসাহ পায় এবং তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে না যায়। দুঃখজনকভাবে এসব করা হয়নি। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বড় ধরণের প্রণোদনা যেমন ছিল না তেমনি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিষয়কেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
কোনো এক বছর,সম্ভবত ১৩৯৯ সালে নয়,হয়তো এর আগের বছর ১৩৯৮ সালে উৎপাদন খরচ ছিল ভোক্তার খরচের চেয়ে বেশি। এ ধরণের কিছু বিষয় উৎপাদন বৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যাইহোক ১৩৯৯ সালে উৎপাদন বৃদ্ধির বিপ্লবী প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। দেশের জনগণও উৎপাদন বৃদ্ধিকে সীমিত ও নির্দিষ্ট পর্যায়ে স্বাগত জানিয়েছে। এখন এই প্রক্রিয়াকে অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে।
ফার্সি ১৪০০ সাল শুরুর মধ্যদিয়ে আসলে আমরা একটা নয়া শতাব্দীতে প্রবেশ করছি,একটা নতুন শতাব্দী শুরু হচ্ছে। কাজেই দেশের নানা বিষয়কে এখন দেখতে হবে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে। দীর্ঘ মেয়াদকে বিবেচনায় নিতে হবে। ফার্সি ১৪০০ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটা বছর,কারণ এই বছরের শুরুর দিকেই (প্রেসিডেন্ট) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৪০০ সালের খোরদদ মাসেই গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এই নির্বাচন দেশের পরিস্থিতির ওপর,দেশের ভবিষ্যতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারে। নয়া সরকার ক্ষমতায় আসবে,সম্ভবত নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে তারা আসবে,ইনশাআল্লাহ নানা বিষয়ে দৃঢ় মনোবল নিয়ে তারা ময়দানে অবতীর্ণ হবে এবং নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবে। এই নির্বাচন নতুন বছরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলবে,নির্বাচন সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে আমি আরও কথা বলব। আজ আর এ বিষয়ে কথা বাড়াব না।
যাইহোক ফার্সি ১৩৯৯ সালে উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশ কিছুটা এগিয়েছে। চলতি বছর অর্থাৎ ১৪০০ সালে এই উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করার ভালো সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিতে হবে,উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জোরালোভাবে সর্বাত্মক আইনি, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সহযোগিতা দিতে হবে। নতুন সরকার আসার আগ পর্যন্ত বর্তমান সরকারকেই এই কাজ এগিয়ে নিতে হবে, আর নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর তাদেরকেও শুরু থেকেই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও সমর্থন দিতে হবে যাতে নতুন বছরে সত্যিকার অর্থেই উৎপাদন বৃদ্ধির শ্লোগান বাস্তবায়িত হতে পারে ইনশাআল্লাহ। এ কারণে আমি এ বছরের শ্লোগানকে এভাবে রেখেছি- ‘উৎপাদন, সহযোগিতা-সমর্থন ও বাধা দূরীকরণ’। এটাই এ বছরের শ্লোগান। আমরা উৎপাদনকে একটি মূল কাজ হিসেবে গণ্য করব,এতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও সমর্থন দেব এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা অপসারণ করব। আশাকরি আল্লাহর রহমতে এই শ্লোগান বাস্তবায়িত হবে ইনশাআল্লাহ।
পরবর্তী সময়ে আমি এ বিষয়ে এবং আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে আরও কথা বলব। আশাকরি আমাদের মহান ইমাম (খোমেনী) ও শহীদদের পবিত্র আত্মা আমাদের ওপর সন্তুষ্ট থাকবেন এবং নতুন বছর ইরানি জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। আশাকরি যুগের ইমাম ইরানি জাতি, দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এবং প্রত্যেক নাগরিকের জন্য দোয়া করবেন। ইরানি জাতি অতীতের মতো দয়া, অনুগ্রহ ও আনুকূল্য পাবে ইনশাআল্লাহ।
ওয়ালাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ও বারাকাতুহ