আজ হযরত আলী ও হযরত ফাতিমার ১৪৪০ তম বিয়ে বার্ষিকী

Bangla Radio 40 views
পয়লা জিলহজ হচ্ছে 'আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.) ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর বিয়েবার্ষিকী'। ইরানে এ দিবসটি পালন করা হয় 'পরিবার দিবস' হিসেবে।

হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) বেহেশতি নারীদের সর্দার তথা খাতুনে জান্নাত। তাঁর অসাধারণ নানা গুণ ও অতি উচ্চস্তরের খোদাভীতির বিষয়টি সবাই জানতেন। তাই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফাসহ  অনেকেই এই মহামানবীকে বিয়ে করার জন্য মহানবীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা) তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। মহানবী বলতেন,ফাতিমার ব্যাপারটি আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ ফাতিমার বিয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে সম্পন্ন হবে।

আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাসূলের কাছে গিয়ে বলেন,‘যদি ফাতিমাকে আমার সাথে বিয়ে দেন তাহলে মূল্যবান মিশরীয় কাপড় বোঝাই এক হাজারটি উট এবং আরও এক হাজার দিনার তথা এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা মোহরানা হিসাবে প্রদান করব।’ রাসূল (সা.) এ প্রস্তাবে খুব অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন,‘তুমি কি মনে করেছ আমি অর্থ ও সম্পদের গোলাম? তুমি সম্পদ ও অর্থ দিয়ে আমার সাথে বড়াই করতে চাও?’

হযরত ফাতিমার বিয়ে প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেন,‘আল্লাহর ফেরেশতা আমার কাছে এসে বললেন,আল্লাহ আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং বলেছেন,তিনি আপনার কন্যা ফাতিমাকে আসমানে আলী ইবনে আবি তালিবের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আপনিও তাঁকে জমিনে তাঁর সাথে বিয়ে দিন। বলা হয় ৪০ হাজার ফেরেশতা ছিলেন বেহেশতে অনুষ্ঠিত এই শুভ বিয়ের সাক্ষী।

দ্বিতীয় হিজরিতেই হযরত ফাতিমার সাথে হযরত আলীর বিয়ে হয়। তাঁর বিয়ের বিষয়ে ইতিহাসে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে তাঁর মর্যাদা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) পরবর্তীকালে বলেন,‘আলীর জন্ম না হলে ফাতিমার সুযোগ্য স্বামী পাওয়া যেত না।’   

বিয়ের সময় হযরত ফাতিমার বয়স ছিল মাত্র দশ-এগারো বছর। অথচ ফাতিমার এ বয়সেই রাসূল বলছেন,‘আলীর জন্ম না হলে ফাতিমার সুযোগ্য স্বামী পাওয়া যেত না।’- এ কথার মধ্যে কত বড় রহস্য লুকিয়ে ছিল তা পরবর্তীকালে প্রকাশ হয়েছে। ইসলামের জন্য হযরত আলী (আ.)-এর ত্যাগ ও অবদান কিংবদন্তীতুল্য অমর ইতিহাস হয়ে আছে। বদর,উহুদ,খন্দক ও খায়বারসহ অন্য অনেক যুদ্ধে তাঁর অতুলনীয় বীরত্বের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। অন্যদিকে তিনিই হলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞানের ভাণ্ডার।

রাসুলে খোদা যখন নবুয়্যত পান, তখন কিশোর আলীই তাঁর প্রতি প্রথম ইমান আনেন। শুধু তাই নয়, নবীজিকে তিনি সবসময় ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তাঁর বীরত্ব, জ্ঞান গরিমা,ত্যাগ,প্রজ্ঞা ও সাহসিকতায় রাসুল (সা.) ছিলেন মুগ্ধ। আর সেজন্যই তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাকে প্রাণপ্রিয় আলীর সাথেই বিয়ে দিয়েছিলেন।

হযরত আলী (আ) ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য মহানবীর (সা) কাছে আসলেও মহানবীর সামনে শ্রদ্ধার কারণে ও লজ্জায় তা বলতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় মহানবী (সা) আঁচ করতে পারেন যে আলী ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছেন। তবুও তিনি বিষয়টা তা-ই কিনা জানতে চাইলে আলী (আ) জানান যে, 'হ্যাঁ, আমি এ উদ্দেশ্যেই এসেছি'।

হযরত ফাতিমা (সা.আ) তাঁর বাবা তথা মহানবীর (সা) পর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত আলীর (আ) সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হবেন- এটাই ছিল স্বাভাবিক। তবুও মহানবী (সা) নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধার আদর্শ তুলে ধরার জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে হযরত ফাতিমার মতামত জানতে চান। চাচাত ভাই আলীকেও তিনি জানান যে ফাতিমার মতামত জেনে আসি। মহানবী প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে বলেন: আমি তোমাকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির স্ত্রী করতে চাই। তোমার কি মত?

ফাতিমা লজ্জায় মাথা নুইয়ে থাকেন এবং হ্যাঁ ও না-বোধক কিছুই না বলে চুপ করে থাকেন। এ অবস্থায় মহানবী বলেন: 'আল্লাহু আকবর'! তাঁর নীরবতা সম্মতিরই প্রমাণ।তাই এটা স্পষ্ট মেয়েদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মত নেয়া জরুরি। জোর করে কোনো নারীকে কোনো পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়া বৈধ নয়।  

দ্বিতীয় হিজরির ১ জিলহাজ্জ রোজ শুক্রবার হযরত আলীর সাথে হযরত ফাতিমার শুভ-বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ সময় হযরত আলীর বয়স ছিল প্রায় ২২ অথবা ২৩। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) সাহাবীদের বলেছিলেন,আল্লাহর আদেশে আমি ফাতিমার সাথে আলীর বিয়ে দিচ্ছি এবং তাদের বিয়ের মোহরানা ধার্য করেছি চারশ মিসকাল রৌপ্য।

এরপর মহানবী (সা.) হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন,হে আলী তুমি কি এতে রাজী আছ? হযরত আলী সম্মতি জানিয়ে বললেন,হ্যাঁ,আমি রাজী। তখন নবীজী দু'হাত তুলে তাঁদের জন্য এবং তাঁদের অনাগত বংশধরদের সার্বিক কল্যাণের জন্য দোয়া করেন।

বিয়েতে বরের পক্ষ থেকে কনেকে দেনমোহর পরিশোধ করা ফরজ। আর হযরত আলী (আ.) নিজের ঢাল বিক্রি করে তা পরিশোধ করেছিলেন। হযরত আলী তাঁর বর্মটি বিক্রি করে ৫০০ দিরহাম বা রৌপ্য মুদ্রা পেয়েছিলেন। একটি উট,একটি তরবারি ও একটি বর্ম এবং কয়েকটি খেজুরের বাগান ছাড়া হযরত আলীর কাছে আর কোনো সম্পদই ছিল না।

হযরত ফাতিমার বিয়ে উপলক্ষে নব-দম্পতির জন্য যেসব উপহার কেনা হয়েছিল মোহরানার অর্থ দিয়ে সেসব ছিল: একটি আতর,কিছু জামা-কাপড় ও কিছু গৃহস্থালি সামগ্রী। বর্ণনা থেকে জানা যায় যে মোট ১৮টি উপহার কেনা হয়েছিল: এসবের মধ্যে ছিল: চার দিরহাম দামের মাথা ঢাকার একটি বড় রুমাল বা স্কার্ফ। এক দিরহাম দামের একটি পোশাক-সামগ্রী। খেজুর পাতা ও কাঠের তৈরি একটি বিছানা। চারটি বালিশ। বালিশগুলো ছিল আজখার নামক সুগন্ধি ঘাসে ভরা। পশমের তৈরি একটি পর্দা। একটি ম্যাট বা পাপোশ। হাত দিয়ে গম পেশার একটি যাঁতাকল। খাবার পানি রাখার জন্য চামড়ার তৈরি একটি মোশক। তামার তৈরি একটি বেসিন বা হাত ধোয়ার পাত্র। দুম্বা বা উটের দুধ দোহনের জন্য একটি বড় পাত্র। সবুজ রং-করা একটি বড় মাটির পাত্র বা জগ।

হযরত আলী জানান- এ বিয়ের উৎসবের জন্য বর্ম বিক্রির অর্থ থেকে কিছু অর্থ সংরক্ষণের জন্য আলাদা করে উম্মে সালামাহ'র কাছে দেয়া হয়েছিল। মহানবী (সা) তার  থেকে দশ দিরহাম নিয়ে আমায় বলেন: কিছু তেল, খেজুর ও 'কাশ্ক' কিনে আন এই অর্থ দিয়ে। সেসব আনা হলে মহানবী তাঁর জামার হাতাগুলো গুটিয়ে সেগুলো মেশানো শুরু করেন নিজ হাতে। ওই তিন খাদ্যের মিশ্রণে তৈরি হল বিয়ের অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য হালুয়া জাতীয় বিশেষ মিষ্টি খাবার।

খাবার তৈরির পর মহানবী আলীকে বললেন,দাওয়াত দাও যতজনকে তুমি ইচ্ছে করছ! আলী বললেন,আমি মসজিদে গিয়ে দেখলাম সেখানে অনেক সাহাবি সমবেত রয়েছেন। আমি তাদের বললাম: মহানবীর (সা) দাওয়াত কবুল করুন। তারা রওনা দিলেন মহানবীর (সা) দিকে। আমি মহানবীকে (সা) বললাম: মেহমানের সংখ্যা তো বিপুল। তিনি বিশেষ খাবারটি ঢাকলেন একটি শিট দিয়ে এবং বললেন: তাদেরকে আসতে বল একসাথে দশ-দশ জন করে। ফলে দশ জনের এক একটি গ্রুপ এসে খেয়ে বেরিয়ে গেলে দশ জনের অন্য গ্রুপ আসছিল। এভাবে বহু মেহমান এসে খাবার খাওয়া সত্ত্বেও তা যেন মোটেও কমছিল না। সাতশত নারী-পুরুষ মহানবীর (সা) বানানো সেই বরকতময় মিষ্টি খাবার খেয়েছিলেন।

মেহমানরা সবাই চলে গেলে মহানবী (সা) আলীকে ডানে ও ফাতিমাকে নিজের বাম দিকে বসিয়ে তাঁদের জন্য দোয়া করেন। তিনি নিজের মুখ থেকে কিছু লালা বের করে তা ফাতিমা ও আলীর ওপর ছড়িয়ে দেন। এরপর আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলেন: হে আল্লাহ! তারা আমার থেকে ও আমি তাদের থেকে! হে প্রভু! আপনি যেমন আমার থেকে সব ধরনের অপবিত্রতা ও কদর্যতা দূর করেছেন,তেমনি তাদের কাছ থেকেও সেসব দূর করে তাদের পবিত্র করুন। এরপর বর-কনেকে বললেন: ওঠো এবং ঘরে যাও। তোমাদের ওপর মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।

বলা হয়- বিয়ের দিন বা রাতে হযরত ফাতিমার কাছে এসে একজন দরিদ্র ব্যক্তি কিছু সাহায্য চাইলে তিনি তার বিয়ের পোশাক দান করে দেন ওই ব্যক্তির কাছে যাতে তা বিক্রি করে ওই ব্যক্তি কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন। ফলে একটি পুরোনো পোশাক পরেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন হযরত ফাতিমা (সা.আ)।

হযরত ফাতিমা ও আলীর বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সাদামাটা। তাই হযরত উম্মে আইমান এসে মহানবীর কাছে দুঃখ করে বললেন,সেদিনও তো আনসারদের এক মেয়ের বিয়ে হল। সে অনুষ্ঠানে কত জাঁকজমক ও আনন্দ-ফুর্তি হল! অথচ বিশ্ববাসীর নেতা মহানবীর মেয়ের বিয়ে কিনা এতো সাদাসিধেভাবে হচ্ছে!

এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন,এ বিয়ের সাথে পৃথিবীর কোন বিয়ের তুলনাই হয় না। পৃথিবীতে এ বিয়ের কোন জাঁকজমক না হলেও আল্লাহর আদেশে আসমানে এ বিয়ে উপলক্ষে ব্যাপক জাঁকজমক হচ্ছে। বেহেশতকে অপূর্ব সাজে সাজানো হয়েছে। ফেরেশতারা,হুর-গিলমান সবাই আনন্দ করছে। বেহেশতের গাছপালা থেকে মণি-মুক্তা ঝরছে! আর সেগুলো সংগ্রহ করছেন বেহেশতের হুরিরা। কিয়ামত পর্যন্ত তারা সেগুলো সংগ্রহ করতেই থাকবেন যাতে সেগুলোর বিনিময়ে পুরস্কার পাওয়া যায়। একথা শুনে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) আলী ও ফাতিমাকে বলে দিয়েছিলেন যে বাইরের কাজগুলো করবে আলী আর ঘরোয়া কাজগুলো করবে ফাতিমা। হযরত ফাতিমা এতে খুশি হয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন,এই শ্রম-বিভাজনের ফলে যেসব কাজ করতে ঘরের বাইরে যেতে হয় ও বার বার পর-পুরুষদের সামনে পড়তে হয় তা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন।

ইসলাম নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেয় বলে এ ধর্ম কখনও নারীকে সামাজিক ভূমিকা পালনে বিরত রাখে না। শালীনতা বজায় রেখে ও সংসারের মূল দায়িত্বগুলো পালনের পাশাপাশি নারী সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে পারেন। মহানবীর (সা) ওফাতের পর হযরত ফাতিমাকে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ফাদাকের বাগান থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং খেলাফতের ব্যাপারেও মহানবীর (সা) নির্দেশ অমান্য করা হয় বলে হযরত ফাতিমা মসজিদে নববীতে গিয়ে হযরত আলীর নেতৃত্বের অধিকার সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন। গৃহস্থালী ও সাংসারিক দায়িত্ব ছাড়াও সব ধরনের সামাজিক দায়িত্বও পুরোপুরি পালন করে গেছেন হযরত জাহরা (সা.আ)। তাই হযরত আলী (আ) বলেছিলেন,'আল্লাহর শপথ! আমি কখনও ফাতিমাকে অসন্তুষ্ট করিনি অথবা তাকে কোনো কাজ করতে বাধ্য করিনি। অন্যদিকে ফাতিমাও আমাকে কখনও রাগিয়ে দেয়নি বা আমাকে অমান্য করেনি। বস্তুত যখনই আমি তাঁর দিকে তাকাতাম আমার অন্তর থেকে সব বেদনা বা দুঃখ দূর হয়ে যেত।' 

 হযরত আলী ও হযরত ফাতিমার বিয়েবার্ষিকীর এই শুভ দিনে আপনাদের সবাইকে আবারও শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে এখানেই শেষ করছি আজকের আলোচনা।#

Add Comments