বিশ্ব কুদস দিবস উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছেন। আজ (শুক্রবার) তিনি রেডিও ও টেলিভিশনে মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশে এ ভাষণ দেন। তার ভাষণে পূর্ণ বিবরণ পার্সটুডের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন,ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা সাইয়্যেদিনা মুহাম্মাদিন খাতামুন নাবিয়্যিন ওয়া আশরাফিল খালকি আজমায়িন ওয়া আলা আলিহিত তায়্যিবিনাত তাহিরিন ওয়া সাহবিহিল মুনতাজাবিন ওয়া মান তাবেয়া’হুম বিইহসান ইলা ইয়াওমিদ্দিন।
ফিলিস্তিন মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন্ত ইস্যু
ফিলিস্তিন এখনও মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন্ত অভিন্ন ইস্যু। জালিম ও নিষ্ঠুর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নীতি একটি জাতিকে তাদের ঘরবাড়ি, জন্মভূমি এবং পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত করে তাদের স্থানে একটি সন্ত্রাসবাদী ও বিজাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে।
ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার খোঁড়া যুক্তি
ইহুদিবাদী ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পেছনে যে খোঁড়া যুক্তি দেখানো হয় তার চেয়ে দুর্বল ও ভিত্তিহীন যুক্তি কি দ্বিতীয়টি আছে? ইউরোপীয়রা দাবি করছে যে,তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোতে ইহুদিদের উপর অত্যাচার করেছে,এ কারণে পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশের জাতিকে বিতাড়িত করে এবং সেদেশে চরম নৃশংসতা চালিয়ে ইহুদি হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে...! এটাই হলো তাদের যুক্তি যার ভিত্তিতে পাশ্চাত্যের সরকারগুলো ইহুদিবাদী ইসরাইলকে পাগলের মতো অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের নিজেদের দাবি ও শ্লোগানকে নিজেরাই লঙ্ঘন করছে। একইসঙ্গে হাসি ও কান্না উদ্রেককারী এই গল্প ও কাহিনী সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত রয়েছে এবং কিছু দিন পরপর এ ক্ষেত্রে নতুন নতুন অধ্যায় যুক্ত হচ্ছে।
ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করা সবার দায়িত্ব
ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিন দখলের প্রথম দিন থেকেই এটাকে সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। ইসরাইল কোনো দেশ নয়,এটি ফিলিস্তিনি জনগণ এবং অন্যান্য মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের একটি ঘাঁটি। এই জঘন্য অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই মানেই জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই। এটা সব মানুষের দায়িত্ব।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও দুর্বলতা, ফিলিস্তিন দখলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে
লক্ষণীয় বিষয় হলো, দখলদার ইসরাইল ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলিম ভূখণ্ডের এই সংবেদনশীল পয়েন্ট দখল করার প্রস্তুতি অনেক বছর আগেই শুরু হয়েছিল। মুসলিম দেশগুলোতে সেক্যুলারিজম ও উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা এবং স্বৈরাচারী,অনুগত ও পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পাশ্চাত্যের সরাসরি হস্তক্ষেপের মধ্যদিয়েই এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ইরান,তুরস্ক এবং পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার আরব দেশগুলোতে সে সময় সংঘটিত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলই এই তিক্ত সত্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে,মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য ও দুর্বলতাই ফিলিস্তিন জবরদখলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে এবং এ কারণেই বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মুসলিম উম্মাহর ওপর এই আঘাত হানতে পেরেছে।
ফিলিস্তিন দখলে ইহুদিবাদী পুঁজিপতিদের সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগসাজশ
শিক্ষণীয় বিষয় হলো,পুঁজিবাদ এবং কমিউনিজম এই উভয় শিবিরই ইহুদিবাদী কারুন তথা পুঁজিপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, ব্রিটেন এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে এটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, ইহুদিবাদী পুঁজিপতিরা অর্থ ও অস্ত্রের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রথম কোনো সরকার যা একটি অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ও সেখানে ব্যাপক সংখ্যক ইহুদিকে পাঠায়। দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইল একদিকে মুসলিম বিশ্বের সেই সময়কার অবস্থা এবং অন্যদিকে ইউরোপীয়দের ষড়যন্ত্র,হামলা ও আগ্রাসনের ফসল।
বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন মুসলিম বিশ্বের জন্য ইতিবাচক
বিশ্ব পরিস্থিতি এখন আর সেই দিনগুলোর অবস্থায় নেই। আমাদেরকে সবসময় এ বাস্তবতা মনে রাখতে হবে। বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য মুসলিম বিশ্বের অনুকূলে পরিবর্তিত হয়েছে। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলী এরইমধ্যে নীতি-নৈতিকতা,ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের দুর্বলতা ও বিশৃঙ্খলাকে বিশ্বের সামনে সুস্পষ্ট করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি ও তাদের দাম্ভিক নেতাদের অপমানজনক অবস্থা, ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা মহামারি মোকাবেলায় এক বছরের ব্যর্থতা ও এই ইস্যুতে সৃষ্ট নানা লজ্জাজনক ঘটনা এবং ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে সাম্প্রতিক বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা-অশান্তি এর সবই পাশ্চাত্য শিবিরের পতনোন্মুখ অবস্থার ইঙ্গিত।
অন্যদিকে,মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঞ্চলে প্রতিরোধ শক্তির উত্থান, তাদের প্রতিরক্ষামূলক এবং আক্রমণের ক্ষমতা বৃদ্ধি,মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে আত্ম-সচেতনতা,অনুপ্রেরণা ও আশাবাদ জোরদার,ইসলাম ধর্ম ও কোরআনের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি,জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি,স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা অর্জনের জোরালো প্রবণতা এগুলো খুবই ভালো নিদর্শন যা আরও ভালো ও সুন্দর ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিচ্ছে।
ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জরুরি
এ ক্ষেত্রে একটি প্রধান লক্ষ্য হতে হবে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং এটা অর্জন করা অসম্ভব কিছু নয়। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। এর উপর সব দেশ এবং পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের ভাগ্য নির্ভর করছে। এটিই হলো সেই বাস্তবতা যা মহান ইমাম খোমেনী (রহঃ)’র আলোকিত হৃদয়কে রমজানের শেষ শুক্রবারকে আন্তর্জাতিক কুদস দিবস ঘোষণা করতে নির্দেশনা দিয়েছে। বায়তুল মুকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা হচ্ছে ইহুদিবাদী শত্রু এবং এর মার্কিন ও ইউরোপীয় পৃষ্ঠপোষকদের জন্য দুঃস্বপ্ন। ‘শতাব্দীর লেনদেন’ নামের ব্যর্থ পরিকল্পনা এবং এরপর কয়েকটি দুর্বল আরব সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা,সেই দুঃস্বপ্ন থেকে দখলদারদের বাঁচার নিষ্ফল প্রচেষ্টা মাত্র। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি: এসব প্রচেষ্টা সফল হবে না। ইহুদিবাদী ইসরাইলের পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে এবং এটা থামবে না।
অধিকৃত অঞ্চলে অব্যাহত প্রতিরোধ এবং ফিলিস্তিনি মুজাহিদদের প্রতি বিশ্বের মুসলমানদের সমর্থন ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে
দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে: প্রথমটি যা দ্বিতীয়টির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, আর তাহলো- ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অব্যাহত প্রতিরোধ এবং জিহাদ ও শাহাদাতের ফ্রন্টকে শক্তিশালী করা। দ্বিতীয়টি হলো,ফিলিস্তিনি সংগ্রামীদের প্রতি বিশ্বজুড়ে মুসলিম জাতি ও সরকারগুলোর সমর্থন। সরকার,বুদ্ধিজীবী,আলেম,দল ও সংগঠন,সাহসী যুবসমাজ এবং অন্য শ্রেণী-পেশার সব মানুষকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। এটাই হলো সেই কাজ যা শত্রুর প্রতারণা ও চক্রান্ত অকার্যকর করে দেয় এবং এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতির জন্যও,যেখানে বলা হয়েছে ‘তারা কি কোন চক্রান্ত করতে চায়? পরিণামে কাফিরেরাই হবে চক্রান্তের শিকার।’ (সূরা আত-তূর, আয়াত ৪২) এটা শেষ সময়ের উদাহরণ সৃষ্টি করে; কুরআনে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ তাঁর কাজের ব্যাপারে পূর্ণ কর্তৃত্বশীল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।’(সূরা ইউসুফের ২১ নম্বর আয়াতের একাংশ।)
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ
এখন আমি আরব যুবকদের উদ্দেশে তাদের ভাষায় কিছু কথা বলতে চাই...
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
সব স্বাধীনচেতা আরব বিশেষকরে যুবকদের প্রতি আমার সালাম। একইভাবে সালাম জানাচ্ছি বায়তুল মুকাদ্দাসসহ ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী মানুষ এবং মসজিদুল আকসার মুরাবিতুনের প্রতি। সালাম জানাচ্ছি প্রতিরোধ সংগ্রামের ব্যাপক সংখ্যক শহীদ বিশেষকরে শহীদ শেইখ আহমদ ইয়াসিন,শহীদ সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভি, শহীদ ফাতহি শাকাকি,শহীদ ইমাদ মুগনিয়াহ,শহীদ আবদুল আজিজ রানতিসি, শহীদ আবু মাহদি আল মোহান্দেস ও প্রতিরোধ সংগ্রামের বিশিষ্ট শহীদ কাসেম সোলাইমানির প্রতি। তাঁরা প্রত্যেকেই বরকতময় ও সফল জীবনযাপনের পর শাহাদাতের মাধ্যমেও প্রতিরোধ সংগ্রামের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছেন।
ফিলিস্তিনিদের জিহাদ এবং প্রতিরোধ সংগ্রামের শহীদদের পবিত্র রক্ত আজও এই পবিত্র ঝাণ্ডাকে উড্ডীন রেখেছে এবং ফিলিস্তিনি জিহাদের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে শত শত গুণ বৃদ্ধি করেছে। ফিলিস্তিনি যুবকরা একসময় পাথর ছুড়ে নিজেদের রক্ষা করত। কিন্তু আজ তারা নিখুঁত ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। পবিত্র কুরআনে ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাসকে ‘পবিত্র ভূমি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে এই পবিত্র ভূমি সবচেয়ে অপবিত্র ও খারাপ লোকদের মাধ্যমে দখল হয়ে আছে। এরা এমন শয়তান যারা সম্মানিত মানুষকে হত্যা করে এবং চরম নির্লজ্জভাবে তা স্বীকারও করে। এই বর্ণবাদীরা ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের মালিকদের ওপর হত্যা-নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের বন্দী করছে এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাদের (ফিলিস্তিনিদের) ইচ্ছা ও মনোবল নষ্ট করতে পারেনি। ফিলিস্তিন আজও জীবন্ত এবং জিহাদ চালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর সহায়তায় তারা শেষ পর্যন্ত ঘৃণ্য শত্রুকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে। পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস এবং গোটা ফিলিস্তিন সেখানকার জনগণের। ইনশাআল্লাহ তারা তা ফিরে পাবে। ‘আর এটা আল্লাহর জন্য কঠিন কিছু নয়।’
ফিলিস্তিন ইস্যুতে সব মুসলিম সরকার এবং জাতির দায়িত্ব রয়েছে। তবে এই সংগ্রামের মূলে রয়েছেন স্বয়ং ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভেতরে ও বাইরে তাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ। তাদের ঐক্য ও অভিন্ন সংকল্প বড় সাফল্য এনে দিতে পারে। বর্তমানে ঐক্যই হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ফিলিস্তিনিদের ঐক্যের শত্রুরা হলো ইহুদিবাদী ইসরাইল,আমেরিকা এবং কিছু রাজনৈতিক শক্তি। তবে ফিলিস্তিনিদের ভেতর থেকে ঐক্য নষ্ট করা না হলে বাইরের শত্রুরা কিছুই করতে পারবে না। এই ঐক্যের ভিত্তি হবে হবে অভ্যন্তরীণ জিহাদ এবং শত্রুদের প্রতি অবিশ্বাস ও অনাস্থা। ফিলিস্তিনের রাজনীতি তাদেরই প্রধান শত্রু অর্থাৎ আমেরিকা,ব্রিটেন এবং দুর্বৃত্ত ইহুদিবাদীদের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না।
গাজা,বায়তুল মুকাদ্দাস,পশ্চিম তীর,১৯৪৮ সালের ভূখণ্ড এমনকি শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা সবাই মিলে একটি একক অস্তিত্ব এবং সবাইকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অভিন্ন কৌশল অনুসরণ করতে হবে। এক অংশকে রক্ষায় অপর অংশকে সোচ্চার হতে হবে এবং যখন চাপ বেড়ে যাবে তখন নিজেদের আয়ত্তে থাকা উপকরণ ও হাতিয়ার কাজে লাগাতে হবে।
এখনবিজয় লাভের বিষয়ে আরও বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শক্তির ভারসাম্যে যে পরিবর্তন এসেছে তা ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে গেছে। ইহুদিবাদী শত্রুরা প্রতি বছরই ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে;যে ইসরাইলি সেনাবাহিনী নিজেকে ‘সদা অপরাজেয়’ বলে দাবি করত সেই বাহিনী লেবাননে ৩৩ দিনের যুদ্ধ এবং গাজায় ২২ দিন ও ৮ দিনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর এখন ‘সদা পরাজিত’ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে;তাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হলো এমন যে দুই বছরে চারটি নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছে;নিরাপত্তা ক্ষেত্রে তারা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে এবং ইহুদিদের মধ্যে ইসরাইল ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে-এসবই ভণ্ড ইহুদিবাদী ইসরাইলের কলঙ্কের উৎস হয়ে উঠেছে। আমেরিকার সহযোগিতায় কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য অবিরাম চেষ্টাও ইহুদিবাদী ইসরাইলের দুর্বলতার আরেকটি প্রমাণ। অবশ্য এসব করেও কোনো লাভ হবে না। কয়েক দশক আগেই মিশরের সাথে তারা সম্পর্ক স্থাপন করেছে,কিন্তু ইহুদিবাদী ইসরাইল ঐ সময়ের চেয়েও এখন অনেক বেশি দুর্বল ও অরক্ষিত। এ অবস্থায় কয়েকটি দুর্বল দেশের সাথে সম্পর্ক কি একে কোনো সাহায্য করতে পারবে?! অবশ্য ঐ দেশগুলোও এই সম্পর্ক থেকে লাভবান হতে পারবে না। ইহুদিবাদীরা তাদের সম্পত্তি বা ভূখণ্ড দখল করবে এবং সেখানে দুর্নীতি ও অনিরাপত্তা ছড়িয়ে দেবে।
অবশ্য এসব বাস্তবতা যেন এই আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি অন্যদের গুরু দায়িত্বকে ভুলিয়ে না দেয়। মুসলিম আলেম ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের উচিৎ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকে হারাম ঘোষণা করা। এর পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী মহল ও স্বাধীনচেতা মানুষদের উচিৎ এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি সবার সামনে ব্যাখ্যা করা। এটা যে পেছন থেকে ফিলিস্তিনকে ছুরি মারার শামিল তা তুলে ধরা।
দখলদার ইসরাইলের পতনোন্মুখ অবস্থার বিপরীতে প্রতিরোধ ফ্রন্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে: প্রতিরক্ষা ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে,কার্যকর অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জিত হয়েছে,মুজাহিদদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে,যুবসমাজের মধ্যে আত্ম-সচেতনতা বেড়েছে,ফিলিস্তিনের সর্বত্র প্রতিরোধ ফ্রন্টের বিস্তৃতি ঘটছে। এর বাইরে সম্প্রতি মসজিদুল আকসা রক্ষায় যুবসমাজ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে এবং ফিলিস্তিনি জাতির সংগ্রাম ও অসহায়ত্ব বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলের জনমতের ওপর প্রভাব ফেলছে।
ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের যৌক্তিকতার বিষয়টি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এটি প্রগতিশীল ও আকর্ষণীয় যুক্তি ও প্রস্তাব: ফিলিস্তিনের প্রকৃত বাসিন্দাদের অংশগ্রহণে ফিলিস্তিনিরা গণভোটের আয়োজন করতে পারে। গণভোটে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারিত হবে। ফিলিস্তিনের প্রকৃত বাসিন্দা তারা যে ধর্ম ও সম্প্রদায়েরই হোক না কেন এই গণভোটে অংশ নেবে এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীরাও অংশগ্রহণ করবে। এই গণভোটের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে তা শরণার্থীদেরকে নিজ ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নেবে এবং যেসব বিজাতীয় এসে সেখানে বসতি গড়েছে তাদের বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বিশ্বজুড়ে প্রচলিত গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই এই দাবি ও প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। এটা যে একটা প্রগতিশীল দাবি তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে। দখলদার ইসরাইল এই দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনি মুজাহিদদেরকে তাদের আইনি ও নৈতিক লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে,তাদেরকে দাবি মানতে বাধ্য করতে হবে। আল্লাহর নামে অগ্রসর হোন এবং জেনে রাখুন ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাঁকে সাহায্য করে’।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ